আসুন, ভ্যাকসিন বিষয়ক কিছু বিভ্রান্তি পরিষ্কার হই

করোনা ভ্যাকসিন

বাংলাদেশে আসা ভারতের বিশ লক্ষ উপহার ভ্যাকসিনের নাম কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন, যার আবিষ্কারক অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা আর প্রস্তুতকারক ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট।

সুতরাং এইটা ভারতের ভ্যাকসিন না। বাংলাদেশে যে ভ্যাকসিন এসেছে কিংবা আসবে বলে চুক্তি হয়েছে সেটা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন। সেরাম ইনস্টিটিউট প্রস্তুতকারক মাত্র।

আরও সহজে বলতে আইফোনের কথা ভাবতে পারেন, এপলের আবিষ্কার। বানানো হয় চায়নায়। কিন্তু কেউ দাবী করে না আইফোন চায়না মাল। এখন আইফোনের স্থলে কোভিশিল্ড বসিয়ে নিলেই বিষয়টা সহজ হয়ে যাবে।

কেন ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট? আর কোন দেশ ছিল না?

এই মুহুর্তে ছিল না। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের এতো বিশাল প্রডাকশন সেরাম ছাড়া অন্য কেউ অল্প মূল্যে দিতে পারবে না।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট পঞ্চাশ বছরের অধিক সময় ধরে ভ্যাকসিন উৎপাদন করে আসচ্ছে। সেরাম ইনস্টিটিউট বর্তমান দুনিয়ার সবচাইতে বড় ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।

প্রতিদিন প্রায় তেইশ লক্ষ করোনা ভ্যাকসিন উৎপন্ন করছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট, মাসে পঞ্চাশ মিলিয়ন, তাদের টার্গেট এক বিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদন যা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হবে। উপমহাদেশে তারাই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যারা এতো বৃহৎ স্কেলে অক্সফোর্ডের ফর্মুলায় করোনার ভ্যাকসিন আশেপাশের দেশগুলোয় সরবরাহে সক্ষম। ব্রাজিল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ সহ আনুমানিক প্রায় ত্রিশটা দেশে সেরামে ভ্যাকসিন রপ্তানি করা হবে।

উল্লেখ্য হেপাটাইটিস বি, বিসিজি, সোয়াইন ফ্লু ভ্যাকসিন , ইনফ্লুয়েঞ্জা , সাপের কাপড়ের এমন বহু বহু ভ্যাকসিন সেরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি।

সেরাম ইনস্টিটিউট, ভারত
সেরাম ইনস্টিটিউট

ভারতের ভ্যাকসিন বাংলাদেশে ট্রায়াল হচ্ছে কি?

হচ্ছে না। অন্তত এখন পর্যন্ত। ভারত আবেদন করেছে , কিন্তু অনুমোদন হয়নি। ভারত বায়োটেক ভারতের আরেকটি প্রতিষ্ঠান যারা নিজেরা ভ্যাকসিন তৈরি করেছে বলে দাবী করছে। তাদের ভ্যাকসিনের নাম কোভ্যাক্সিন যা এখনো বিপণন ব্যবহারে কিংবা বাজারজাতে অনুমোদিত না কেবল ভারতে ট্রায়ালের জন্য অনুমোদন পেয়েছে।

প্রথম ধাপের ট্রায়াল শেষ হয়েছে ভারত চাইছে দ্বিতীয় বা তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল বাংলাদেশে করতে। ভারত বায়োটেক সেই ভ্যাকসিন বাংলাদেশে আসেনি। আসবে তারও অনুমোদন হয়নি।

এফেক্টিভনেসের কথা ভাবলে মর্ডানা কিংবা ফাইজারের ভ্যাকসিন এগিয়ে, প্রায় ৯০ শতাংশ সাকসেস রেট, অপরদিকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন ৬২-৯০ পারসেনট। তবুও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন কেন?

কেন মর্ডানা কিংবা ফাইজারের ভ্যাকসিন নয়?

কারণ মর্ডানা কিংবা ফাইজারের ভ্যাকসিন কেনা, সংরক্ষণ , এবং দেয়ার মত সামর্থ বাংলাদেশের নাই।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের দাম ৩-৪ ডলার, প্রতি ডোজ, দিতে হবে দুই ডোজ দাম ৮ ডলার।

মর্ডানার ভ্যাকসিনের দাম ৩৩ ডলার প্রতি ডোজ, দিতে হবে দুই ডোজ দাম পরবে ৬৬ ডলার।

ফাইজারের ভ্যাকসিন দাম ২০ ডলার ( প্রতি ডোজ, দিতে হবে দুই ডোজ দাম পরবে ৪০ ডলার।

করোনা ভ্যাকসিন

ধরলাম দাম ইস্যু না, আমাদের এক পি কে হালদার যদি দশ হাজার কোটি টাকা মেরে দিতে পারে তবে টেকা পয়সা আমাদের হাতের ময়লা। যদি টাকার হিসাব বাদও দেই তবু মর্ডানা কিংবা ফাইজারের ভ্যাকসিন সংরক্ষণের সক্ষমতা আমাদের নেই । মর্ডানা ভ্যাকসিন মাইনাস ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে সংরক্ষণ করতে হবে আর ফাইজারেরটা মাইনাস ৭০ ডিগ্রী। কোটি কোটি ডোজের এতো ভ্যাকসিন সংরক্ষণের কোল্ড স্টোরেজ আমাদের নেই। আমাদের কেন, বিশ্বের বহু দেশেরই নেই।

অপরদিকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের সাধারণ তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায় মানে আপনি বাসার ফ্রিজেও এই ভ্যাকসিনটি সংরক্ষণ করতে পারবেন।

মোবারক আহমদ খানঃ দ্যা জুটম্যান অফ বাংলাদেশ

যদি সমালোচনা করতে হয় আওয়াজ তুলুন সরকার কেন কেবল একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাকসিন আমদানির দায়িত্ব দিল।

চার পাঁচ ডলারের পরিবর্তে বন্ধু রাষ্ট্র( ! ) হিসেবে আমরা আরও কমে প্রতি ডোজ ভ্যাকসিন কিভাবে পেতে পারি।

ডিলিংসে আমাদের পররাষ্ট্র নীতি কতটা মজবুত।

ভারতে তৈরি হচ্ছে বলেই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন ভালো না, অনিরাপদ, ভ্যাকসিন দিমু না, এইসব বালখিল্যতা বাদ দিতে হবে।

বরং আমাদের আত্ম সমালোচনা করতে হবে ভারত একটা সেরাম ইনস্টিটিউট গড়তে পারলে আমরা কেন আজও সেই মানের একটা ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে পারলাম না। আমাদের এমনভাবে এগিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল যেন অক্সফোর্ড বাংলাদেশের কোন ভ্যাকসিন উৎপাদন সংস্থাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলবে – বস! আমাদের ভ্যাকসিনটা আপনারা বানিয়ে দিন, বাংলাদেশ ছাড়া আমাদের যাওয়ার আর জায়গা নেই।

যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যে ২.২ মিলিয়ন ব্যাক্তি করোনার ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছে। ভ্যাকসিন গ্রহণে এগিয়ে রয়েছে ইসরাইল, আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানির মতো দেশসমূহ।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন যুক্তরাজ্যের ভ্যাকসিন কমিটি এবং জাতীয় মেডিসিন রেগুলেটার বয়স্কদের ভ্যাকসিনটি দেয়ার জন্য অনুমোদন দিয়েছে

পৃথিবীর সেরা সেরা কিছু মাথা করোনার ভ্যাকসিন তৈরি করেছে, গ্রহণ করছে দুনিয়ার কোটি মানুষ। তারা ভ্যাকসিন গ্রহণ করছে কারণ যুগটা বিজ্ঞানের।

গুজব, অযথা ঘৃণা কিংবা মিথ্যা তথ্যের সময় এখন না।ফেসবুক গুজবে নয়, ভরসা রাখুন পূর্ণ তথ্যে। বিশ্বাস করুন বিজ্ঞানে।


রাফিউজ্জামান সিফাতের বইসমূহ

Leave a Reply

Your email address will not be published.