বিসিএস ক্যাডার-জাদুকরী এক আলোক ঝলকানি

বিসিএস ক্যাডার

আজ কিছুদিন ধরে লাগাতার জাতীয় দৈনিকে বিসিএস উন্মাদনার কিছু চিত্র তুলে ধরছি,

*স্ত্রীর অনুপ্রেরণায় ৩৮তম বিসিএসে প্রথম হয়েছেন রুহুল

*ফেরিওয়ালার মেয়ে বিসিএস ক্যাডার, বই কিনতে না পারা মেয়ে হলেন এসপি।

*ফেসবুকে আনফ্রেন্ড, বন্ধুর সাথে জিদ করে বিসিএস ক্যাডার

*বিদেশে সংসার সামলে বিসিএস ক্যাডার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী

*বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েও ভর্তি হতে না পারা ছেলেটি এখন বিসিএস ক্যাডার

*৩৮তম বিসিএস: স্বামী শিক্ষা ক্যাডারে ইতিহাসে প্রথম, স্ত্রী অষ্টম

*কখনো কোচিং করেননি বিসিএস প্রশাসনে প্রথম রুহুল

*হতে চাইলাম শিক্ষক, বানাইলেন ম্যাজিস্ট্রেট

*রাতে ছাদে হাঁটতে হাঁটতে বিসিএসের প্রস্তুতি নিতেন সোনিয়া

*জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পঞ্চমবারের চেষ্টায় বিসিএসে সফল হলেন তৃপ্তি

* ‘আয়া’ মায়ের ছেলে বিসিএস ক্যাডার

গত কয়েকদিনে দেশের সমস্ত প্রধান জাতীয় দৈনিকের আলোচিত সংবাদ বিসিএস সম্পর্কিত সংবাদগুলো যেভাবে গ্লোরিফাই করে প্রচারিত হচ্ছে দেখে মনে হবে বিসিএস আলাদিনের চেরাগ। এই দেশে কুদরত-এ-খুদা, জহির রায়হান দরকার নাই, দরকার ভূরি ভূরি বিসিএস ক্যাডার।

মহাবিশ্বে বিসিএসের চেয়ে উত্তম কিছু নেই। ট্র্যাম্পের নির্বাচনী প্রচারনা থেকে শুরু করে, ভারত চায়না সীমানা দ্বন্দ্ব সব হচ্ছে বিসিএস ক্যাডারের পদ নিয়ে।

পঙ্গপালের মতো সবাই ছুটছি বিসিএসে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ হতে প্রস্তুতি চলে বিসিএসের।

অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও গবেষণা নেই, উদ্ভাবনী নেই, ব্যবসার বিকাশ নেই, হ্যারিকেনে খুঁজে উদ্যোক্তার দেখা মেলে না।

ইউজিসির এক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, দেশের ৬৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হয় না। গবেষণার বদলে চলে মুখস্থনির্ভর চাকরিকেন্দ্রিক পড়ালেখা!

৪১তম বিসিএসে আবেদনকারী ৪ লাখ ৭৫ হাজার!

সবাই ক্যাডার হতে চায়, অথচ প্রশাসনে পোস্ট সীমিত। যদি নতুন চাকুরীর বাজার সৃষ্টি না হয় তবে বাকি লাখ লাখ ছেলেমেয়েগুলো কোথায় যাবে?

গবেষণা, উদ্ভাবন, উদ্যোক্তা, বেসরকারি উদ্যোগ, ব্যবসা ছাড়া যে কোন দেশ মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য।

দেশের চাকা চালাতে প্রয়োজন প্রতিটি পেশায় মেধাবীদের উজ্জ্বল পদচারনা।

মেধাবীরা শুধু বিসিএসের পিছনে ছুটলে অযোগ্য ব্যাক্তিরা অতি নির্বিঘ্নে অন্যান্য দরকারি পেশার মার্কেট দখল করবে।

যার পরিনাম ভয়াবহ।

ভুল চিকিৎসায় সেদিন বিসিএস ক্যডারের স্ত্রীর জীবন বিপন্ন হতে পারে। বিসিএস ক্যাডারের সন্তানের সুশিক্ষার জন্য মেধাবী শিক্ষকের প্রয়োজন। যদি শিক্ষকতায় যোগ্য ব্যাক্তি না আসে তবে বিসিএস ক্যাডারের সন্তানই তো পরবর্তীতে বিসিএস ক্যাডার হতে পারবেন না!

অযোগ্য ব্যাক্তি ব্যাংক দখল করলে চাকুরী শেষে একজন বিসিএস ক্যাডারের সারা জীবনের সঞ্চয় লাপাত্তা হয়ে যাবে।

ব্যবসায় দুষ্ট লোকের আগমন হলে আমাদের সন্তান বিষাক্ত খাবার খেয়ে বড় হবার বদলে বনসাই হয়ে বেঁচে উঠবে।


আমেরিকার নাগরিকত্ব ছাড়ছে বিল গেটস কিন্তু কেন?


বিসিএসের বিরোধী আমি নই। প্রচণ্ড পরিশ্রমী দীর্ঘ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হচ্ছেন তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এক্ষুনি আমাদের চাকুরী কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন করার সময় চলে এসেছে।

দেশ কেবলমাত্র ক্যাডার দিয়ে চলতে পারে না। প্রশাসন অধিকর্তার পাশাপাশি আমাদের জগদীশ চন্দ্র বসু লাগবে, আমাদের দরকার ডাক্তার দ্বীন মোহাম্মদ দরকার, দরকার অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, আমাদের দরকার ট্রান্সকমের লতিফুর রহমান, ব্র্যাকের ফজলে হাসান আবেদ, গ্রামীন ব্যাংকের মোহাম্মদ ইউনুস, গণস্বাস্থ্যের জাফরুল্লাহ চৌধুরী, পাঠাও অ্যাপের ইলিয়াস হোসেন।

কিন্তু সবাই যদি বিসিএস ক্যাডার হতে চায় তবে একবার চিন্তা করুন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কিন্তু এই ব্যাক্তিদের মতো নক্ষত্রসম পেশাদারিত্বের সেবা হতে নিদারুণ বঞ্চিত হতে যাচ্ছে!

সব পেশা বাদ দিয়ে বিগত কয়েক বছর বিসিএসকেই গ্লোরিফাই করা হচ্ছে, কেন এতো ক্যাডার উন্মাদনা?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, বুয়েট ছুটছে বিসিএসের পিছনে! কেন?

চাকুরীর বাজার

কারন মনে করা হয়, গত কয়েক বছরে বিসিএস একটি নিরাপদ চাকুরীর আশ্বাস। অবারিত সরকারী সুবিধার পাশাপাশি ভালো বেতন কাঠামো আর নিরুংকুশ ক্ষমতা!

এই যদি কারন হয় তবে এরচেয়ে ভয়াবহ দুঃসংবাদ এই দেশের জন্য আর হতে পারে না।

সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট একটি ছেলে যদি আজ ক্ষুদ্র স্বাধীন ব্যবসা তৈরি করতে চায় বর্তমান পরিস্থিতিতে সে দাঁড়াতেই পারবে না। সামাজিক অসহযোগিতার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সুবিধা এই মামা চাচা বিহীন ছেলেটি পাবে না। পদে পদে তাকে বাঁধার সম্মুখিন হতে হবে। তার পুঁজি নেই, মূলধন যুগিয়ে রিস্ক নেয়ার ইনভেস্টর নেই, চারপাশে চাঁদাবাজের তাণ্ডব, আছে পারিবারিক লাঞ্ছনা! ছেলেটি একসময় নিজেকে অনিরাপদ মনে করে পিছিয়ে আসবে। এভাবেইই হয়তো হারিয়ে গেল ক্ষুদ্র শিল্প থেকে বৃহৎ শিল্পের একটি অমিত সম্ভাবনা।

প্রাইভেট জব কর্মীদের চাকুরীর নুন্যতম নিরাপত্তা দিতে পারছে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মীরা সর্বদা চাকুরী হারানোর আতংকে থাকে। কেন এরুপ পরিস্থিতি। কর্মী বান্ধব একটি স্থিতিশীল বেসরকারি চাকুরী কাঠামো স্বাধীনতার এতো বছর পরও কেন গড়ে উঠল না। এই প্রশ্ন করতে হবে উচ্চকণ্ঠে।

প্রফেশনালরা নিজ প্রতিষ্ঠানে কেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে?

দেশে কেন গবেষক তৈরি হয় না, আমাদের উদ্যোক্তারা কি কি বাঁধার সম্মুখীন হয়, একজন উদ্যোক্তা একশো জনের চাকুরীর সুযোগ তৈরি করতে পারে অথচ আমাদের দেশে উদ্যোক্তাদের অবহেলা অপমান কেন? এই প্রশ্নগুলো বারবার করে এর সমাধান বের করে নিয়ে আসতে হবে।

প্রায় তিরিশ লক্ষ যুবক বেকার, আগামী কয়েক বছরে সংখ্যা হতে যাচ্ছে দ্বিগুণ। পরিবার হতাশ, দেশ জুড়ে ভয়াবহ ফ্রাস্ট্রেশনে তরুণ প্রজন্ম।

বিসিএস ক্যাডারকে গ্লোরিফাই করে ভয়াবহ এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। দেশকে বাঁচাতে পুরো চাকুরী ব্যবস্থাপনার আশু সংস্করণ অতি জরুরী।

বিসিএসের পিছনে আমাদের সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা দিনরাত ছুটলে কোন বাংলাদেশী কোনদিন চাঁদের বুকে পা ফেলার চিন্তা কল্পনাতেও আনতে পারবে না।

গবেষণা, উদ্ভাবন, উদ্যোক্তা ব্যতীত নিজেদের মাটিতে গর্ব করার মতো কিছুই তৈরি হয় না। বছর কয়েক পরপর বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের কানি ইঞ্চি সাফল্য দেখেই সারাজীবন অহংকার করে যেতে হবে। আমাদের ঘরে বসে টিকটকে ভিডিও-ই বানিয়ে যেতে হবে, একটা টিকটক অ্যাপ্লিকেশন বানানোর মতো ফান্ডিং, সাপোর্ট জোগাড় হবে না।

পাশের দেশের ছোট শিশুরা যখন মহাশূন্যের বুকে হেঁটে বেড়াবার স্বপ্ন দেখবে আমাদের সন্তানরা তখন পত্রিকা পড়ে ভাববে – রুহুল ভাই বস, বিসিএসে চান্স পাইছে। রুহুল ভাইয়ের ভালো বিয়া হবে!


রাফিউজ্জামান সিফাতের বইসমূহ

Leave a Reply

Your email address will not be published.