সালমান শাহ্‌: এই ঘর এই সংসার এ এক বিন্দু আনন্দ অশ্রু

সালমান শাহ্‌

আমার বয়স তখন অল্প। ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬, অন্যান্য স্মৃতি আবছা আবছা মনে পড়লেও এ দিনটা আমার স্মৃতিতে খুব স্পষ্ট। খুব সম্ভবত আমার বাল্যকালে সেই দিনটিই ছিল আমার দেখা প্রথম বড় ঘটনা।

শুক্রবারের ছুটির দুপুরে বাংলা ছায়াছবি ছিল আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের প্রধান বিনোদন। জুম্মার নামায শেষে দুপুরের খাওয়া জলদি খেয়ে বসে যেতাম বিটিভি’র সামনে। বেলা তিনটার বিটিভি’র পর্দা উঠত। পর্দা উঠার আগ পর্যন্ত বিকট শব্দ হতো। হাই ফ্রিকোয়েন্সির পর্দা উঠানোর বিদঘুটে শব্দও আমাদের খুব ভালো লাগত। চোখ বড় বড় করে টেলিভিশনের দিকে চেয়ে থাকতাম। কোরআন তেলয়াতের পর পবিত্র ত্রিপিটক পাঠ হত। শুনতে শুনতে গেরুয়া থান কাপড়ের ভদন্ত শীলভদ্র মহাথের ত্রিপিটক পাঠ পর্যন্ত মুখস্ত করে ফেলেছিলাম। নম্য তস্য ভগবৎ আহরত … (এখন আর মনে নাই)

৩.১৫ মিনিটে একজন উপস্থাপিকা বাংলা ছায়াছবির নাম ঘোষণা করতেন। সুধী দর্শক মণ্ডলী এখন আপনারা দেখবেন পুর্নদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি … শ্রেষ্ঠাংশে … শাবানা আলমগিরের ছবিতে ভালোবাসা বিরহ আঘাত সুখ সবই থাকত, জসীমের ছবিতে কষ্ট থাকত বেশি, ও লাইফটা খুব স্ট্রাগলের।

ওমর সানি মৌসুমি, সালমান শাহ শাবনুর কিংবা শাবনাজ নাইমের ছবিতে নাচ গান ফুলের টোকাটুকি বেশি। সবাই মিলে দেখতে লজ্জা লাগত। গান শুরু হলেই মুরুব্বিরা গলা কাশি দিয়ে উঠে যেত। ইয়ংরা চঞ্চল চোখে দেখত, দেখাতেই সুখ।

ময়মনসিংহে আমাদের বাসার পাশেই ছিল ছাত্রী হোস্টেল। হোস্টেলে টেলিভিশন দেখার ব্যবস্থা ছিল না, হোস্টেলের অ্যান্টিরা (মেয়েদের সবাইকে আমি অ্যান্টি বলে ডাকতাম) আমাদের বাসায় এসে ভিড় জমাতো সিনেমা দেখতে। ড্রয়িং রুমে এতো মেয়ের জায়গা হত না। যারা আগে আসত তারা রুমে ঢুকতে পারত, বাকিরা জানালা দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাংলা সিনেমা দেখতে। এই সময়টাকে বাংলা ছায়াছবির স্বর্ণযুগ বলে।

সেদিনও ছায়াছবির মাঝে নিয়ম অনুসারে বিকাল ৪/ ৫টার সংবাদ হচ্ছিল। কয়েক মিনিটের সংবাদকে আমরা বিরতি ধরে নিতাম। তখন শরীর টানা দিয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গা হতো, টিভির কাছাকাছি থেকে একটু হাঁটাহাঁটি করা হতো, চট জলদি চা বানানো হতো, সিনেমার আগের দৃশ্য নিয়ে আলোচনা চলতো।

বিরতিকালীন এমন টুকটাক আলোচনার মধ্যেই আলগোছে সংবাদ পাঠকের গলা কানে ভেসে এলো।একটি বাক্য শান্ত বিকেলের ফুরফুরে আমেজকে হঠাৎ তিনশ ষাট ডিগ্রী এঙ্গেলে পরিবর্তন এনে দিল। সংবাদ পাঠকের মুখ গোমরা করে বললেন চিত্রনায়ক সালমান শাহ্ ইন্তেকাল করেছে। আকস্মিক আমি আমার চারপাশে তীব্র আর্তনাথের চিৎকার শুনতে পেলাম। ছাত্রী হোস্টেলের সমস্ত মেয়েরা যে যেখানে ছিল দৌড়ে আসতে শুরু করলো টিভি সেটের সম্মুখে।অবিশ্বাস্য চোখে এ ওকে জিজ্ঞাস করে “আমি হয়তো ভুল শুনেছি , তুই কি শুনেছিস ?” এক একজন নীরবে মাথা ঝাঁকায় , আর এক একটি কান্নার স্রোত আমি দেখতে পাই। তখন ব্রেকিং নিউজ এর যুগ ছিল না এক নিউজ বারবার ঝিরঝির করতো না চোখের ডগায় । তারপরও সবাই অধির আগ্রহে দাড়িয়ে ছিল বোকা বাক্সের সামনে। যদি খবটি মিথ্যে হয়? সংবাদ পাঠক ভুলেও সালমান শাহ্ বলতে পারে” বিটিভি সেদিন অন্তত ভুল বলেনি।

সালমান শাহ্

সেদিনের পর টানা কয়েক মাস আজাদ প্রোডাক্টের সালমান শাহ্ ভিউকার্ড, পোস্টার আমি সবার হাতে হাতে দেখেছি। তখন প্রতিদিন শুনতাম দেশের বিভিন্ন জেলায় সালমান শাহর মৃত্যুর খবরে কয়েকজন সুইসাইড করেছে। আমাদের বাসায় যিনি কাজ করতেন তিনি ঘর মুছতে মুছতে বলতেন ছাত্রী হোস্টেলের অনেক মেয়ে কয়েক বেলা খাওয়া দাওয়া করছে না। কয়েকজন সালমান শাহের জন্য সারারাত নফল নামায পরছে, কেউ কেউ সিলেট চলে গেছে সালমান শাহ্‌র কবর জিয়ারত করতে, শাহ্‌ জ্বালাল মাজারের অন্যতম আকর্ষণ ছিল সালমান শাহ্‌র কবর। এখনো হয়ত তাই।

বছর কয়েক আগে সিলেট ভ্রমণে গিয়ে সালমান শাহ্‌র কবরে আমি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মোমবাতি জ্বলতে দেখেছি। মৃত্যু স্বাভাবিক। কষ্ট পেলেও মৃত্যুকে মেনে নিতে হয় । কিন্তু আমি দেখেছি কিছু কিছু মৃত্যুকে মেনে নেয়া ভয়াবহ রকমের অসম্ভব হয়ে দাড়ায়। একজন বহু দুরের কেবলমাত্র পর্দায় দেখা মানুষের মৃত্যু একটি সমাজকে কি অদ্ভুত বদলে দিয়েছিল।

বর্তমান দেশীয় চলচ্চিত্র নিয়ে অনেকের মাঝে নেগেটিভ চিন্তা , হাস্যরসময়তা , ক্ষোভ দেখা গেলেও এক সালমান শাহ্ বিষয়ে সমগ্র হতাশামূলক ধারাপাত যেন স্তব্দ হয়ে যায়। মৃত্যুর প্রায় দুই যুগের বেশি সময় পরও আজও পত্রিকার বিনোদন পাতায় গুরুত্ব নিয়ে আছে সালমান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখনো দেশের প্রধান নায়ক সালমান শাহ্‌!

বছর খানেক আগে সেদিন একটি জনপ্রিয় এফএম রেডিও সালমান শাহ্ নিয়ে স্পেশাল শো আয়োজন করেছিল যেখানে সুদূর ইংল্যান্ড থেকে টেলিফোনে যুক্ত হয়েছিল সালমান শাহর মা। সালমানের ছবি সংবলিত টি- শার্ট বের করেছিল তার ভক্তরা। তিন দিনেই বিক্রি হয়ে যায় ২০ হাজার টি-শার্ট। সালমান শাহ্র প্রতি জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীতে ফেসবুকের দৃশ্য পাল্টে যায় । প্রিয় নায়কের ছবি প্রোফাইল পিকচার হিসেবে থাকে। মৃত্যুর এতো বছর বাদে আর কে এভাবে প্রচণ্ড প্রতাপে বিরাজ করছে? লক্ষ কোটি ভক্তদের ” অন্তরে অন্তরে ” এমন আর একজন তুমুল জনপ্রিয় নায়কের উদাহরণ কি আমরা আর দিতে পারবো? সম্ভব নয় । এখন পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্র একজন কেবল মাত্র একজন মহানায়ক জন্ম দিয়েছে। সে সালমান শাহ্।

মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সের স্মার্ট , সুদর্শন মিষ্টি হাসির এই নায়ক ২৮টি চলচিত্র দিয়ে নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে সালমান শাহ্ হয়ে উঠেছিলেন অতি “প্রিয়জন,” “এই ঘর এই সংসার“ অনেক নায়কই এসেছে কিন্তু কতোজন পেরেছে ভক্তদের “সুজন সখী“ হতে? যে দেশের চলচিত্র শিল্প নিয়ে দিস্তা দিস্তা হতাশা, সেই দেশের রঙ্গিন পর্দায় “ স্বপ্নের ঠিকানা “ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন সালমান শাহ্। মাত্র সাড়ে তিন বছরের ক্যারিয়ার দিয়ে এতো বছর পরও তিনি দর্শকের লেখায়, ভক্তদের স্মৃতিতে। সালমান শাহ মুভি আমাদের চোখে এনে দিতে পারে “আনন্দ অশ্রু”। তার মৃত্যু রহস্য নিয়ে এখনো হয় জল্পনা কল্পনা। মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর দৈনন্দিন “চাওয়া থেকে পাওয়া”র সকল লেনদেন শেষে আজও বেঁচে থাকলে সালমান কি করতেন তার হিসেব কষে। বাংলা চলচ্চিত্র প্রেমী অগণিত মানুষের বিশ্বাস ছিল সালমান শাহ্‌ই পারতেন বাংলা ছায়াছবিকে বিশ্ব দরকবারে পৌঁছে দিতে। একজন নায়কের পক্ষে কোটি মানুষের পবিত্র এই “আশা ভালোবাসা“ পাওয়া সহজ নয়। সহজ নয় বলেই তিনি সালমান শাহ্‌। তিনি “স্বপ্নের নায়ক”


রাফিউজ্জামান সিফাতের বইসমূহ

Leave a Reply

Your email address will not be published.