সেন্টমার্টিন ট্র্যাজিডি । নেপথ্যে প্রশাসনের গাফিলতি । চাই নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্র

সেন্টমার্টিন ট্র্যাজিডি । নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্র চাই

১৪ এপ্রিল , ২০১৪ । সেন্টমার্টিন নীল সমুদ্র । সমুদ্রে মারা গেল সদ্য ইঞ্জিনিয়ার খেতাব প্রাপ্ত চার যুবক । এখন পর্যন্ত নিখোঁজ আরও দুইজন ( ২০ এপ্রিল, ২০১৪ )

একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সহজেই বলা যায় এই ছয়জন মেধাবী যুবকের এইভাবে হারিয়ে যাওয়া নিছক কোন দুর্ঘটনা নয় । তাদের চলে যাওয়ার পিছনে প্রধান কারন প্রশাসনের চরম গাফিলতি এবং দেশের পর্যটনশিল্পের অনিরাপদ ব্যবস্থাপনা ।

সেন্টমার্টিনের উত্তর পূর্ব কোণ সৈকত যে জায়গায় আমার বন্ধুরা পানিতে ডুবে মারা যায় সেই স্থানটি এক ভয়াবহ বিপদজনক খাদ বা রিপ কারেন্ট

কোমর সমান শান্ত পানি । অথচ মাত্র এক স্টেপ সামনে এগোলেই প্রায় দেড়শ ফুট গভীর খাত । স্থানীয়দের মতে গত তিন বছরের ঠিক সেই জায়গায় মারা যায় প্রায় ১৩ জন ( নিখোঁজ দুইজনকে বাদ দিয়ে )

এতোটা বিপদসংকুল স্থান অথচ আশেপাশে নেই একটি লাল পতাকা । নেই বিপদজনক স্থান সমূহ চিহ্নিত করণসরুপ কোন সাইনবোর্ড ।

শুধু সেখানে কেন, সমগ্র সেন্টমার্টিনে নেই সচেতনতা মূলক কোন সাইনবোর্ড , যা দেখে কোন পর্যটক বুঝতে পারবে কোথায় কি আছে , কোথায় বিপদ জনক স্থান ! কিচ্ছু নেই । আবার বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন নিয়ে আমাদের পর্যটন শিল্পের চলছে রমরমা বিজনেস ।

( সেন্টমার্টিন ট্র্যাজিডি – নীল চিহ্নিত করা স্থান সেই মৃত্যুকুপ)

বন্ধুরা সামনে প্রিয় মুখগুলো ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে , ভাটার টানে গভীর খাদের আরও ভিতরে চলে যাচ্ছে ছেলেগুলো । বাঁচার জন্য তাদের তীব্র আকুতি। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত উদ্ধারকর্মী ছাড়া তাদের ঐ স্থান থেকে উদ্ধার পাওয়া প্রায় অসম্ভব ।

আমরা পাগলের মতো তাদের উদ্ধাররের জন্য চিৎকার করে যাচ্ছি । ছুটছি এদিক , ওদিক। কেউ নেই । আশেপাশে নেই একজন লাইফগার্ডও । নেই উদ্ধার করবার মতো কোন প্রকার রেস্কিউ টিউব , লাইফজ্যাকেট, দড়ি বা কোন কিছু ।

স্থানীয় মানুষের সহায়তায় উদ্ধার করা হল কয়েকজনকে । তাদের ভিতর সঙ্গে সঙ্গে মরে গেল দুইজন । ইভান এবং অংকুর । নিখোঁজ হল আরও চারজন । যাদের ভিতর দুইজনকে তার দুদিন পর সমুদ্র থেকে উদ্ধার করা হয় । এখনো নিখোঁজ আরও দুইজন । সাব্বির , উদয় । তারা সকলেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষার্থী।

বা পাশ থেকে – ইভান, অংকুর, বাপ্পি, সাব্বির, উদয়, নোমান

আমরা দেখেছি সেন্টমার্টিন প্রসাশনের দুর্বলতা । তারা যেন মৃত্যুর সমস্ত আয়োজন করে সাজিয়ে রাখে আগত পর্যটকদের জন্য । কেউ জীবিত ফিরে আসতে পারলে সেটা তার ভাগ্য ।

মৃত্যুবরণকারী মানুষটি মরে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ড আগেও টের পাবে না তাকে সেন্টমার্টিনের নাজুক দুর্বল প্রসাশন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে অপরিকল্পিত পর্যটনকেন্দ্রের মাধ্যমে । যেখানে নিরাপত্তার বিন্ধুমাত্র সুযোগ নেই । এর চেয়ে বাজে পরিনতি আর কি বা হতে পারে।

নেটওয়ার্কের বাইরে
সাব্বিরের দেয়া শেষ স্ট্যাটাস – নেটওয়ার্কের বাইরে

আমি জবাব চাই মাত্র এক হাত লাল কাপড়ের মূল্য কতো ?

আমি জবাব চাই কুইক রেস্কিউ টিম কেন এমন বিপদ জনক এরিয়ায় সার্বক্ষণিক তৈরি থাকে না ?

জানতে চাই কেন হোটেল ব্যবসায়ী তাদের টুরিস্টদের সাবধান করে দেয় না ?

প্রতি রাস্তায় একটা বিপদ সংকেত মূলক সাইনবোর্ড কেন লাগানো হয় না ?

আমরা জানতে চাই । উত্তর চাই।

ইতিমধ্যে গত ১৯ এপ্রিল আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সুমুক্ষে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের সরাসরি স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহনে “নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্র চাই : পর্যটন এলাকাতে অবিলম্বে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মানববন্ধন” অনুষ্ঠিত হয় ।

ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য আমাদের শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনে আমরা তুলে ধরি ১২ দফা দাবী । দাবী সমূহ —

১) প্রতি পর্যটনকারীদলের সাথে একজন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত “পর্যটক গাইড” নিয়োগের বাধ্যতামূলক নিয়ম চালু করতে হবে ।

২) পর্যাপ্ত এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য উক্ত পর্যটন এলাকায় নিশ্চিত করতে হবে । সমুদ্রের জন্য কুইক “ লাইফ গার্ডের” সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করতে হবে ।

৩) বিপদজনক পর্যটন এলাকায় বিশেষ সতর্কতা মূলক সাইন ব্যবহার করতে হবে ।

৪) স্থানীয় জনগন যেন উদ্ধার কাজে সহায়তা করতে পারে তারজন্য তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে ।

৫) প্রতি পর্যটন এলাকার জন্য একটি করে আলাদা পর্যটক গাইড বই এর ব্যবস্থা করতে হবে । যেখানে উক্ত এলাকার সমস্ত বিবরণ চিত্র সহকারে বর্ণিত থাকবে ।

৬) পর্যটন এলাকায় ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল ইউনিট স্থাপন করতে হবে ।

৭) বিপদজনক স্থানসমূহ রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে এবং জনসাধারনের প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে । বিষয়টি তদারক করতে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ করতে হবে ।

৮) পর্যটন এলাকার সর্বত্র দ্রুত উদ্ধার কাজ পরিচালনার জন্য “ উদ্ধারকারী বুথ ” স্থাপন করতে হবে ।

৯) “ওয়াচ টাওয়ার” সহ প্রতি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে “ সচেতনামূলক সাইনবোর্ড “ স্থাপন করতে হবে ।

১০) প্রত্যেক পর্যটন এলাকায় যেকোন প্রয়োজন স্বার্থে একটি বিশেষ ইমারজেন্সি মোবাইল নাম্বার প্রদান করতে হবে ।

১১) প্রতিটি স্কুল , কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক চিকিৎসা সম্বন্ধীয় জ্ঞান লাভের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে ।

১২) পর্যটন এলাকার প্রতিটি হোটেল ব্যবসায়ীদের উক্ত এলাকা সম্পর্কে পর্যটকদের বিস্তারিত ধারনা দিতে হবে এবং প্রতি রুমে বিপদজনক স্থান চিহ্নিত করণসহ একটি গাইড ম্যাপ সরবরাহ করতে হবে ।

সেন্টমার্টিন ট্র্যাজিডি । নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্র চাই
সেন্টমার্টিন ট্র্যাজিডি । নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্র চাই
সেন্টমার্টিন ট্র্যাজিডি । নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্র চাই
সেন্টমার্টিন ট্র্যাজিডি । নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্র চাই
সেন্টমার্টিন ট্র্যাজিডি  ২০১৪। নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্র চাই
সেন্টমার্টিন ট্র্যাজিডি । নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্র চাই
সেন্টমার্টিন ট্র্যাজিডি । নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্র চাই
সেন্টমার্টিন ট্র্যাজিডি ২০১৪ । নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্র চাই
সেন্টমার্টিন ট্র্যাজিডি ২০১৪ । নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্র চাই

গত কিছুদিন যাবৎ সমস্ত মিডিয়া , ফেসবুকে মাতম সেন্টমার্টিনে পর্যটন মন্ত্রানালয়ের কাছে বলি হওয়া ছয় শিক্ষার্থীদের জন্য ।

জানি কিছুদিনের মধ্যেই কালো ফেসবুক আবার রঙিন হয়ে যাবে । ছয়টি নাম আর বুকে চিন চিন কাঁপন ধরাবে না । প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে আমাদের কিবোর্ডের খট খট আওয়াজ আর চোখ ভিজাবে না । হতে পারে এইটাই প্রকৃতির নিয়ম । প্রকৃতি হয়তো চায় না হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মুখ চোখ লেপ্টে রাখতে সর্বক্ষণ । সময় পরিবর্তন ঘটাতে পারে সব কিছুর । সময়ের ক্ষমতা অসীম ।

রাফিউজ্জামান সিফাত এর পাঠক প্রিয় উপন্যাস – “মনোপাখি”

মনে প্রানে চাই — রঙিন ফেসবুক আর যেন কোনদিন কালো করতে না হয় । তার জন্য ই খুব ছোট পরিসর থেকে ডাক দিয়েছিলাম নিরাপদ বাংলাদেশের । নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্র নিশ্চিৎ করনে আমাদের শক্তি যুগিয়েছে সেই হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মুখগুলো ।

আমাদের বন্ধুটি কথা দিয়েছিল তার মাকে সে নববর্ষের চার দিনের মধ্যে ফিরে আসবে বাসায় । সন্তান মাকে দেয়া কথা রাখতে পারেনি । তাকে রাখতে দেয়া হয়নি ।

আমাদের লড়াই ছিল প্রতিটি সন্তান যেন তার মাকে দেয়া কথা রাখতে পারে । বোনের অনাগত সন্তানকে নিয়ে ভবিষ্যৎ মামার স্বপ্ন যেন আর নষ্ট না হয় আমাদের সংগ্রাম ছিল তার জন্য ।

সংগ্রাম ছিল বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষার ।

লড়াই ছিল ভালোবাসার মানুষটির কাছে ফিরে আসার ।

নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্র চাই ” ব্যানারে আমরা যে আন্দোলন শুরু করেছি সেটি আমার জন্য । আপনার জন্য । আমাদের জন্য । একে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এখন সবার ।

বিশ্বাস করি বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র সমাজ এখন যেভাবে এগিয়ে আসচ্ছে , সামনে আরও আসবে ।

প্রতিটি বাংলাদেশী নিজের অধিকার আদায়ে এগিয়ে আসবে । নন পলিটিক্যাল একদল সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে ” নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্রের ‘ যে দাবী আজ বাংলাদেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে সেটি সুস্পষ্ট ভাবে প্রমান করে — আমরাই পারি ।

আমরাই পারি পরিবর্তন ঘটাতে । দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি — পরিবর্তন ঘটবেই । ঐ তো আলো দেখতে পারছি , আর একটু পথ ।


রাফিউজ্জামান সিফাতের বইসমূহ

Leave a Reply

Your email address will not be published.