আমরা একজন ইলিয়াস কাঞ্চন পেয়েছিলাম

ইলিয়াস কাঞ্চন

তখন তিনি নিজ হাতে বিস্কুট বানানো শিখেছেন, খুব ইচ্ছে ছিল প্রথমবারের মতো হাতে বানানো বিস্কুট খাইয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে চমকে দিবেন।

বানিয়েছিলেন তিনি। নিজ হাতে বানান বিস্কুট সাথে করে নিয়েও যাচ্ছিলেন স্বামীর কাছে কিন্তু গন্তব্যে আর পৌঁছানো হয়নি। ১৯৯৩ সনে ঢাকা থেকে বান্দরবন যাওয়ার পথে রোড এক্সিডেন্টে মারা যান জাহানারা কাঞ্চন।

ইলিয়াস কাঞ্চন তখন সিনেমার শুটিং এ ছিলেন। হোটেল থেকে তার কাছে ফোন আসে। বলে, ‘স্যার, আপনি ঘাবড়াবেন না, আপনার স্ত্রীর আসার কথা ছিল, গাড়িটা অ্যাকসিডেন্ট করেছে, উনারা মোটামুটি ভালো, আপনি শুটিং প্যাক করে শিগ্রী চলে আসুন।’

জাহানারা কাঞ্চন ইলিয়াস কাঞ্চন
জাহানারা কাঞ্চনের সাথে ইলিয়াস কাঞ্চন

ইলিয়াস কাঞ্চন পাগলের মত দৌড়ে হোটেলে ফিরলেন। তখনো তিনি জানেন না তার জাহানারা কেমন আছেন। তবে ইউনিটের অন্যরা জেনে গেছে জাহানারা কাঞ্চন আর নেই, সড়ক দুর্ঘটনায় জাহানারা কাঞ্চন স্পট ডেড।

ইলিয়াস কাঞ্চনকে জানানো হয়নি।

‘আমি হোটেলে ফিরে আসরের নামায পড়লাম, সবাই তাগাদা দিচ্ছিল তাড়াতাড়ি চলেন। হাসপাতাল যাওয়ার পথে রাস্তায় গাড়িটা দেখলাম, মনটা কেমন শূন্য হয়ে গেল। গিয়ে দেখলাম বাচ্চাদুটো কাঁদছে, আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম।’

এ যাবতকালে দেশের ইতিহাসে সবচাইতে ব্যবসা সফল সিনেমা (প্রথম তিনমাসে প্রায় চল্লিশ কোটি টাকা আয়, বারশ সিনেমা হল মাসের পর মাস হাউজফুল) যার টিকেট পেতে আগের দিন সন্ধ্যা থেকে লাইন দিয়ে দাঁড়াত দর্শক, সেই বেদের মেয়ের জোছনার নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন প্রায় সাতাশ বছর ধরে স্ত্রীর ছবি বুকে নিয়ে তিনি নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে রাস্তায়।

লড়াইটা ভাইয়ের জন্য ভাইয়ের, লড়াইটা একটা পরিবারের

সিনেমার দুর্দান্ত ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়েছেন, সুপার হিট নায়ক থেকে সড়ক পরিবহনের সন্ত্রাসীদের চোখে হয়েছেন ভিলেন। তাকে নিয়ে ট্রল হয়েছে, আজও প্রায় প্রতিদিন তিনি পান মৃত্যুর হুমকি কিন্তু তিনি রাজপথ ছাড়েননি। একদিনের জন্যও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবী থেকে এক চুল সরে আসেননি।

জাহানারা কাঞ্চন ইলিয়াস কাঞ্চন
জাহানারা কাঞ্চন ইলিয়াস কাঞ্চন

নিরাপদ সড়কের দাবীতে গত সাতাশটি বছর ধরে তিনি ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ হয়ে লড়ছেন।

ফোর লেন, ডিভাইডার, হাইওয়ে পুলিশ, একমুখী যান চলাচল, নিরাপদ সড়ক দিবস, সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন একজন ইলিয়াস কাঞ্চনের সংগ্রাম।

নিজেদের মাটিতে ইলিয়াস কাঞ্চনের অর্ধেক জীবনের সন্ধান পেলেও বলিউড হলিউড একের পর এক দুর্দান্ত অটোবায়োগ্রাফিক মুভি তৈরি করে হইচই ফেলে দিত।

রাষ্ট্র দিত সর্বোচ্চ সম্মান ও নিরাপত্তা।

আর এখানে? এই দেশে ইলিয়ান কাঞ্চনের ছবিতে জ্বালানো হয় কুশপুত্তলিকা, শ্লোগানে তার দুই গালে জুতার বাড়ি দেয়ার তীব্র ইচ্ছা পোষণ করা হয়, তার ছবি ব্যানারে ঝুলিয়ে হত্যার হুমকি রোজকার ঘটনা, বরং হুমকিদাতাদের উৎসাহ প্রদান করা হয়।

(হুমকিদাতাদের কখনোই কাউকে আটক বা শাস্তি দেয়া হয়নি)

ছোট বড় সংব্বর্ধনা ব্যাতিত জাতি হিসেবে ইলিয়াস কাঞ্চনের লড়াইকে আমরা কিছুই দিতে পারেনি। হয়তো তিনি আমাদের থেকে কিছু প্রত্যাশাও আর করেন না।

রাফিউজ্জামান সিফাতের বইসমূহ

তার দাবী একটাই, নিরাপদ সড়ক। ইলিয়াস কাঞ্চনের দাবী এই দেশে আর একজন ছাত্রও যেন সড়কে অকাল মৃত্যু বরন না করে, বাবা যেন কাঁধে সন্তানের লাশ বহন না করতে হয়, আর কোন মায়ের বুক খালি যেন খালি না হয়, আর কোন জাহানারা যেন সড়কে মৃত্যু বরন না করে, ইলিয়াস কাঞ্চনের দাবী একটাই।

প্রতিটা সমাজ বাস্তব জীবনে একজন হিরো প্রত্যাশা করে

সৌভাগ্য আমরা একজন ইলিয়াস কাঞ্চন পেয়েছিলাম।

হিরো এমনই হয়।