রানী হামিদ ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ‘এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ’ দাবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করেন। এশিয়ার সেরা দাবাড়ুরাই কেবলমাত্র সেই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিল।
টুর্নামেন্টে রানী হামিদের শুরুটাই হয়েছিল পরাজয় দিয়ে। প্রথম ম্যাচে হারের পর দ্বিতীয় ম্যাচও হারেন। তৃতীয় ম্যাচে আরও বড় ব্যবধানে হেরে বসেন।
দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন নারী চেস মাষ্টার রানী হামিদ সেই টুর্নামেন্টে এভাবেই একের পর এক ম্যাচ হারতে থাকেন। ইভেন্টের শেষে রানী হামিদের স্কোর ০.০/ ৯, টুর্নামেন্টের ৩৬ জনের তালিকায় তার অবস্থান ৩৫!
টেবিলে সবার নিচে নাম তার তবুও আজও সেই টুর্নামেন্টে আলোকিত করে রেখেছেন চেস মাষ্টার রানী হামিদ।
হেরেও তিনি সবার চেয়ে ব্যাতিক্রম ছিলেন একটি বিষয়ে।
রাণী হামিদের লড়াকু মানসিকতা।
একের পর এক পরাজয়েও তিনি টুর্নামেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে আসেননি। ময়দান ছাড়েননি।
রাণী হামিদ যখন এই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেন তখন তার হাতে সেরাদের সেরা খেতাব। সাদা কালো দাবা বোর্ডের যুদ্ধের ময়দানে তিনি বাংলাদেশের মহারাণী।
দেশের প্রথম নারী আন্তর্জাতিক মাস্টারের খেতাব রাণী হামিদের ঝুলিতে। স্বীকৃতি হিসেবে রাণী হামিদের শোকেসে অলিম্পিয়াড, চেজ গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস। ব্রিটিশ নারী দাবা প্রতিযোগিতায় তিনবারের চ্যাম্পিয়ন! ১৯৮৫ সালে তিনি ফিদে আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার খেতাব অর্জন করেন। জয় করেছেন জাতীয় নারী দাবায় ব্যক্তিগত ২০তম শিরোপা।
উনার আর তো অর্জনের কিছু ছিল না। চুয়াত্তর বছর বয়সে তিনি সকল সম্মান পুরষ্কারই পেয়েছিলেন। বরং বেশীই অর্জন করেছিলেন। তবুও তবুও রাণী হামিদ আবারও লড়াইয়ে নাম লেখালেন। বারবার হারছেন। কিন্তু খেলা ছাড়লেন না।
এক ম্যাচ হারলে ঠিক পরের ম্যাচেই আবার নব উদ্যমে খেলতে নামলেন। মিডিয়ায় কে কি সমালোচনা করল, কে মন্দ বলল, হাসল, বোর্ডে অবস্থান কিচ্ছু পাত্তা দেননি তিনি। র্যাংকি-এ চোখ রাখেননি, পরাজয়ে হতাশ হননি। এই বয়সে সম্মানের ভয়ে পালিয়ে আসেননি। খেলা চালিয়ে গেছেন। খেলতে গিয়েছিলেন, শেষ অবধি খেলে গেছেন।
পঞ্চাশের শেষ সীমানায় দাঁড়ালেই যখন অধিকাংশ মানুষ হাত পা ঝাড়া দিয়ে অবসর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠে, সমস্ত কাজ থেকে ছুটি নিয়ে একলা ঘরে আবদ্ধ হয়ে পরিবারের মুখাপেক্ষী হয়ে গোনে মৃত্যুর দিন।
রানী হামিদ সেখানে চুয়াত্তর বছর বয়সে বিশ্বের অন্যান্য দেশের বাঘা বাঘা তরুন দাবাড়ুদের সাথে বুদ্ধির পাঞ্জায় ম্যাচের পর ম্যাচ লড়াই চালিয়ে যায়।
এক ম্যাচ হারলে পরের ম্যাচে তিনি চেষ্টা করেন নিজের সর্বোচ্চ খেলাটা উপহার দিতে।
সেইবার তিনি পারেননি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভাগ্যও সহায়তা করেননি। বারংবার ম্যাচ হেরেছেন, পরাজিত হয়েছেন, র্যাংক টেবিলে প্রতিদিন একটু একটু পিছিয়ে পড়েছেন। কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যও মনোবল হারান নাই। এক ম্যাচ হেরে পরের ম্যাচে বিশ্বাস নিয়ে খেলতে নেমেছেন, এইবার জিত হবে।
৭৯ বছরের যুবক জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য
বহু তরুন তরুণী প্রেমের অভিমানে, পরীক্ষার খারাপ ফলাফলে, বন্ধুদের অপমানে, চাকুরী না পেয়ে হতাশায় আত্মগ্লানিতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। তারা পরাজয় সহ্য করতে পারে না। পরাজয়কে ওরা ভাবে জীবনের চরমতম অপমান, সম্মানহানী।
তারা প্রতি মুহূর্ত কেবলই জিততে চায়। ক্ষণিকের ছন্দপতনকে ভেবে নেয় ব্যর্থতা। আগাম ব্যর্থতার ভয়ে লড়াইয়ের আগেই তারা হেরে বসে।
অথচ জীবন মানেই বহু সংখ্যক ব্যর্থতার সমষ্টিগত ফলাফল।
এখানে লড়ে যাওয়াটাই প্রাপ্তি। কর্মই অর্জন।
হেরে যাওয়ার আগে আমাদের তরুণরা কি একটিবার রানী হামিদের এই গল্পটি পড়বে?
৭৪ বছর বয়সী রানী হামিদ শেষ ম্যাচ পর্যন্ত মাটি কামড়ে লড়ে গেছেন।
লড়ে লড়ে রানী হামিদ জিতে গিয়েছেন।
একটি বারের জন্যও তিনি বলেননি– I QUIT
রাফিউজ্জামান সিফাতের বইসমূহ