ছেলে আজ রাতে আমাদের বাইরে খাওয়াবে। তার জীবনের প্রথম স্যালারি পেয়েছে।
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে বাবলু সব টাকা আমার হাতে তুলে দিয়ে বলে- কিছু টাকা আলাদা রেখে দাও মা, রাতে আমরা বাইরে খাবো। তুমি বাবাকে জানিয়ে দিও।
বাবাকে সরাসরি বলার সাহস ছেলেটার আজও হল না। একটা ব্যবধান তৈরি হয়েছে বাপ আর ছেলের ভিতর। আমি স্পষ্ট টের পাই। ওরাও হয়তো পায়।
বাবলুটা বরাবরই তার বাপকে ভয় পেয়ে এসেছে। লোকটাও কেমন যেন কাঠ খোট্টা হয়ে থাকে ছেলের সামনে। হাসি নেই, মুখে সবসময় বিরক্তি অথবা টেনশন। শেষ কবে হাসি মুখে আমাদের সাথে কথা বলেছে মনে করতে পারছি না।
ছাপোষা নিন্মপদস্থ কর্মচারি, সারাটা জীবন ৯-৫ টা অফিস করে করে অভ্যস্ত। সামান্য বেতনে নিজের সংসারের পাশাপাশি তার স্বামী মারা যাওয়া বোনের পুরো সংসার, ছোট ভাইদের মানুষ করবার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখন যেন প্রাণ চলে গিয়েছে মানুষটার।
ওকে তাই আর দোষ দেই না। বিয়ের পর এইসব দেখে প্রতিবাদ করলেও আস্তে ধীরে মেনে নিয়ে পঁচিশটা বছর যেভাবে পাড় করে দিয়েছি, বাবলুটাও মেনে নিয়েছে খুব ছোট থাকতেই। বাবাকে তাই কোন কিছু বলার দরকার হলে মা তার সম্বল।
বাপ ছেলের মাঝে পিয়নের কাজ করতে আমার মন্দ ও লাগে না।
(২)
– বাবলু প্রথম স্যালারি পেয়েছে। রাতে আমাদের রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে চায়।
– কয় টাকা পেয়েছে যে খাওয়াতে চায়? টাকা পয়সা জমাতে বোলো। রাতে মুরগী রান্না করো, বাসাতেই খাবো। বাইরে দরকার নেই।ফখরুল আহমেদ পত্রিকা থেকে চোখ না সরিয়েই কথা বলে।
আমি ঘর থেকে বের হয়ে ছেলের কাছে এলাম। অফিস থেকে ফিরেই বাবলু বিছানায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়েছে। আমার শব্দ পেয়ে তাকাল।
– তোর বাবার শরীর মনে হয় ভালো না, বাসাতেই থাকতে চাচ্ছেন। আমি পোলাও মাংশ চড়িয়ে দিচ্ছি। সাথে থাকবে তোর পছন্দের ঘিয়ে ভাজা বেগুন বড়া।
বাবলু শুকনো হাসি হেসে ল্যাপটপে চোখ রাখল।
আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
বাবা ছেলের এই দ্বন্দ্ব কি সব পরিবারেই হয় নাকি কেবল আমার সংসারেই?
আমি ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।
(৩)
আটটা বাজে। সন্ধ্যার দিকে উনি বাইরে বেড়িয়েছেন পোলাও এর চাল কিনে আনতে, এখনো ফিরেণনি। বাইরে মেঘ ডাকছে। বাতাস আছে বেশ। বৃষ্টি হবে আজ রাতে।
আমি মোবাইল হাতে নিলাম কল করবো ভেবে তখন ই কলিংবেলের শব্দ।
দরজা খুলে দিলাম। ছিটে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, উনার শার্ট বৃষ্টির দাগ, মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে গম্ভীর গলায় বলল – তোমার ছেলেকে ডাক দাও।
বাবলু বাবার সামনে এসে দাঁড়াল। তার মাথা নিচু। আমি একটু দূরে দাড়িয়ে। মনে মনে আয়তুল কুরশি পড়ছি।
– ভিতরে একটা শার্ট আছে। দেখো তো মাপ মতো হয় নাকি?
তিনি ছেলের দিকে একটি প্যাকেট বাড়িয়ে দিলেন।
আমার কান্না চলে আসচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে আটকে রাখছি। উনি আমার দিকে তাকালেন
– তুমি দূরে দাড়িয়ে আছো কেন? এই শাড়িটা তোমার জন্য। ছেলে প্রথম বেতনে খাওয়াবে, মায়ের শাড়িটা নতুন হওয়া চাই।
তিনি মুচকি হাসেন। অনেকদিন পর তার হাসি দেখলাম। আমি বাচ্চা মেয়েদের মতো দৌড়ে শাড়ি নিলাম।
আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি নেমে এলো। ছাপোষা অতি মধ্যবিত্ত একটি পরিবারের টিনের চালে বৃষ্টি তার সমস্ত ভালোবাসা খুলে দিয়েছে।
আরও গল্প পড়তে স্টোরি সেকশনে চলে আসুন