৭৯ বছরের তরুণ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য

জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্য

ঢাকা মেডিকেলে তার জন্য আলাদা কেবিনের ব্যবস্থা ছিল। যে কেবিন এই করোনা কালীন সময়ে সোনার হরিণের চেয়েও বেশী কিছু সেখানে তিনি যাননি। নিজের তৈরি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছেন। বিশ্বাস রেখেছেন নিজের প্রতিষ্ঠানের ডাক্তারদের প্রতি। তিনি বলেন, আমার চিকিৎসক, সেবিকারা আমাকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছে বলেই আজ আমি কথা বলছি। নিজে সুস্থ হয়ে প্রথম তার মাথায় যে কথাটা এসেছে তা হল,

আমি যে সুবিধা পেয়েছি, আমি চাই একই সুবিধা বাংলাদেশের প্রত্যেকটা নাগরিক পাক।

তার দুটো কিডনি প্রায় অকেজো। তার মতো রোগীদের জন্য করোনা সবচাইতে ভয়াবহ। করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিনি জ্ঞান হারিয়েছিলেন। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বিভিন্ন সময় তাকে অক্সিজেন দেয়া হয়েছে। তিনি বেঁচে উঠেন। সুস্থ হবার পর তিনি খোঁজ নিয়েছেন তাকে কতো টাকার অক্সিজেন দেয়া হয়েছিল। নিজের প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিচ্ছেন তবুও তিনি টাকার হিসেব রেখেছেন!

হিসেব করে তিনি বের করেছেন অসুস্থতার সময় তাকে পাঁচশ টাকার মতো অক্সিজেন দেয়া হয়েছিল।

তিনি বলেন চিকিৎসার খরচ বেশী না। অল্প টাকায় চিকিৎসা সম্ভব। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র তৈরি করে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সেই অল্প চিকিৎসার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

তার মতে,

যৌক্তিক চিকিৎসা ব্যয়বহুল না। দুর্নীতিটা ব্যয়বহুল। চিকিৎসকদের আত্মবিশ্বাসটা ব্যয়বহুল।

যদিও বেসরকারি হাসপাতালে অক্সিজেনের নল লাগালেই লাখ টাকার উপর বিল ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে।

বিদেশে তো আমি যাবো না

তিনি অসুস্থ হলে অনেকেই তাকে চিকিৎসা নিতে বিদেশে যেতে বলছেন। এই দেশে এমন সুযোগ কে ছাড়ে!! অথচ সব সুযোগ থাকা শর্তেও তিনি বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাননি।

তিনি বলেন,

বিদেশে তো আমি যাবো না। আমার সাধারন মানুষ যে চিকিৎসা পাবে না সে চিকিৎসা আমি নিব না

হার্ভার্ড মেডিকেল বিনামূল্যে তার কিডনি প্রতিস্থাপনের চিকিৎসা করতে চেয়েছিল, তিনি রাজি হননি। তার কথা, তুমি আমাকে বিনামূল্যে করবে, অন্যদেরটা কি হবে? আমি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ঠিক করতে চাই। যেন সবাই একই সুবিধা পায়।


মোবারক আহমদ খানঃ দ্যা জুটম্যান অফ সোনার বাংলা


তিনি মনে করেন, চিকিৎসা হবে সুলভ, কম খরচ, জবাবদিহিতামূলক। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য সেই লক্ষ্যেই তো কাজ করে যাচ্ছে। তিনি তৈরি করেছেন কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার।

উপমহাদেশে এতো কম খরচে এতো বড় কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার আর কোথাও নেই।

করোনা কালীন সময়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গবেষক দল তৈরি করেছিল স্বল্পমূল্যের করোনা শনাক্তকরণ ও অ্যান্টিবডি কিট

দেশীয় স্বাস্থ্য নীতি, ওষুধ শিল্প নীতির প্রনোয়নের মূল কাণ্ডারিদের একজন তিনি । এইসব নীতি প্রনোয়নের কারণে বহু মানুষের বিরাগভাজন হন তিনি। বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন থেকে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে বের করে দেয়া হয়।

কিন্তু জাফরুল্লাহ চৌধুরী মানুষটা ভিন্ন ধাতুতে গড়া। তিনি পিছপা হননি। সাহস করে সত্য বলে গিয়েছেন, কাউকে তোষামোদ করেননি, আপোষ করেননি। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সেই স্বাস্থ্য, ওষুধ নীতির সুফল বাংলাদেশ ভোগ করছে। আজ বিদেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হয়! লক্ষ পরিবারের কর্মসংস্থান আজ বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প।  


‘I QUIT’ প্রজন্মের রানী হামিদ এর গল্পটি জানা ভীষণ প্রয়োজন


বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন থেকে জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে বের করে দেয়া হলেও ব্রিটিশ মেডিকেল এসোসিয়েশন জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মূল্য ঠিকই বুঝতে পারে।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী একমাত্র বাংলাদেশী যিনি ব্রিটিশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের আজীবন গর্বিত সদস্য। চিকিৎসাশাস্ত্রে বিশ্বের অতি সম্মানজনক এই পদে ব্রিটিশ মেডিকেল এসোসিয়েশন জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে ডেকে নিয়ে সম্মানিত করে।

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য

এখানে বলে রাখা ভালো, নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানে তিনি কিন্তু মালিকানা দাবী করেননি। জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, মালিক নন।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কোনো সম্পদের ওপর তিনি কোনো প্রকার অধিকার রাখেননি।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কেবলমাত্র মালিক বাংলাদেশের জনগণ!


বিদ্যানন্দের কিশোর কুমার দাসঃ সময়ের বাতিঘর


নিজেকে তিনি বলেন এই মুহুর্তে সবচাইতে ভাগ্যবান রোগী। সর্বোচ্চ পর্যায়ের দুই নেত্রী নিয়মিত তার খোঁজ নিয়েছেন। একজন তার চিকিৎসার জন্য আলাদা কেবিন দিয়েছিলেন (তিনি যাননি), অন্যজন তার জন্য ঝুড়িভর্তি ফল পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

তিনি মনে করেন, প্রধান দুই নেত্রীর মধ্যে ভালোবাসা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। রাজনৈতিক সাহসটা ফিরে পেতে হবে। তিনি স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসেন।

বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের থেকে খরচ চল্লিশ এক লাখ টাকা যে যেভাবে পারছে নিচ্ছে। সেখানে তিনি গণস্বাস্থ্যে করোনা রোগীদের জন্য একটা ওয়ার্ড তৈরি করতে যাচ্ছেন যেখানে অক্সিজেনের সুবিধা থাকবে। দৈনিক খরচ হবে পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা।


লড়াইটা ভাইয়ের জন্য ভাইয়ের, লড়াইটা একটা পরিবারের


নিজে করোনা রোগী ছিলেন, চিকিৎসা পেয়ে এখন সুস্থ। অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন করোনা হলেই সবার আইসিইউ লাগে না। দরকার স্বাভাবিক চিকিৎসা। চিকিৎসক, সেবিকাদেরকে রোগীদের নিজের আত্মীয় মনে করে চিকিৎসা দিতে হবে। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশে সেটা হচ্ছে না।

তার মতে, দেশের সবচেয়ে ভালো হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ।

যুদ্ধ ও যোদ্ধা

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ইংল্যান্ডে ডাক্তারি পড়ছিলেন। যুদ্ধের খবর পেয়ে ডাক্তারি পড়া বাদ দিয়েই তিনি দেশে চলে আসেন। আগরতলায় প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেন। তৈরি করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল যা পরবর্তীতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামে পরিচিতি পায়।

নিজে মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসক ছিলেন। সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করেছেন বলেই তিনি বিশ্বাস করেন, একজন যোদ্ধা কখনো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে পারে না।

প্রথম আলো’র সাথে সাক্ষাৎকারে জাফরুল্লাহ চৌধুরী সামনের পরিকল্পনার কথা জানান।

দেশের মূল শক্তি গ্রাম। গ্রাম, ইউনিয়ন পর্যায়ের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে তিনি শক্তিশালী করার কথা বলেন। তিনি বলেন চিকিৎসকদের গ্রামে ইউনিয়নে গিয়ে থাকতে হবে, গ্রামে গ্রামে সেবা দিতে হবে।

ঢাকা শহরকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র একশোটি ভাগে ভাগ করে তিনি চিকিৎসা সেবা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। এতে রোগী দ্রুত চিকিৎসা পাবে, হাসপাতালের উপর অত্যাধিক চাপ কমবে।

বিদেশের অত্যন্ত ব্যয়বহুল কিডনি প্রতিস্থাপনের চিকিৎসা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য সর্বসাধারণের জন্য এ দেশেই তৈরি করতে চান। তিনি একটি আধুনিক ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরি করতে চান। তিনি চান একটি কার্ডিয়াক সেন্টার করতে চান। যার কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য সুলভমূল্যে করোনা টেস্টিং ( এন্টিবডি, এন্টিজেন ) কিট উৎপাদন করে করোনা দুর্যোগে সাধারণের পাশে দাঁড়াতে চান। তিনি দেশে এক্কতি আধুনিক বিজ্ঞান একাডেমি তৈরি করতে চান, যেখানে বিশ্বের সকল প্রান্তের বাংলাদেশীরা গবেষণার সুযোগ পাবে।

ডেঙ্গু নির্ণয়ের কিট নিয়ে কাজ শুরু করতে যাচ্ছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।

তিনি সাহায্য আশা করেন না। কেবল দাবী, তার কাজে যেন বাঁধা দেয়া না হয়। এইটুকুই।

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বয়স ৭৯ বছর। করোনা থেকে সেরে উঠলেও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। কথা বলতে প্রচন্ড কষ্ট হয় তার। তবুও হাসপাতাল কেবিনে বিছানার পাশে টেবিল চেয়ার নিয়ে বসে পড়েছেন। সেখানেই বসেই কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলছেন,

এখনও অনেক কাজ বাকি !


রাফিউজ্জামান সিফাতের বইসমূহ

4 comments

Leave a Reply

Your email address will not be published.